মাগডেবুর্গ যাবেন কেন? এই কারণে…

Tags: , , ,
মাগডেবুর্গ ক্যাথেড্রালের মিনার

(TAN): আমিও মাগডেবুর্গ গিয়েছিলাম ঠিক বেড়াতে নয় – আমার বইয়ের রিসার্চ করতে।

আপনি কি এমন কোনো মানুষকে চেনেন যিনি জার্মানি বেড়াতে গিয়েছেন এবং যিনি মাগডেবুর্গ গিয়েছেন? আমি তো তেমন কাউকে চিনি না। সত্যি বলতে কি, বার্লিন থেকে একটা ইন্টারসিটি এক্সপ্রেস ট্রেন চেপে দুঘন্টার কিছু কম সময়ে যখন আপনি মাগডেবুর্গ হপ্টবানহফে (প্রধান ট্রেন স্টেশন) নামবেন, জায়গাটা হয়তো খানিক মিয়োনো মুড়ির মতোই লাগবে বার্লিন এর রোমাঞ্চকর vibe-এর তুলনায়। 

কিন্তু তিষ্ঠ! এত তাড়াতাড়ি মাগডেবুর্গকে বোরিং তকমা দিয়ে ফেলবেন না। এ শহরের ইতিহাস বারোশো বছরের। (২০০৫ সালে মাগডেবুর্গ উদযাপন করে শহরের ১,২০০ বছর।) শিল্প, স্থাপত্য আর ইতিহাসে যদি আপনার আগ্রহ থাকে তবে মাগডেবুর্গ, যা ইউরোপীয় মধ্যযুগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলির মধ্যে একটি, আপনাকে হতাশ করবে না। 

মাগডেবুর্গ ওত্তো-র শহর নামে পরিচিত। এর কারণ দুই মানুষ। দশম শতকে এখানে থাকতেন Holy Roman সম্রাট প্রথম Otto, যিনি পরিচিত ছিলেন ওত্তো দা গ্রেট নামে। আবার সতেরো শতকে এখানে থাকতেন রাজনীতিবীদ এবং বৈজ্ঞানিক ওত্তো ভ্যান গুয়েরিকে, যিনি বহু বছর ছিলেন এই শহরের মেয়র। আজকের মাগডেবুর্গ প্রধানত এক ইউনিভার্সিটি টাউন, যার একটার নাম ওত্তো ভ্যান গুয়েরিকে ইউনিভার্সিটি। 

মাগডেবুর্গের সবচেয়ে বিখ্যাত দ্রষ্টব্য হলো মাগডেবুর্গ ক্যাথিড্রাল যেটা চোখে পড়ে শহরের প্রধান সড়ক Breiter Weg থেকে। ৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ওত্তো দা গ্রেট একটি আশ্রম বানিয়ে উৎসর্গ করেন সেন্ট মরিসকে।  গির্জা টি বানানো শুরু হয় ৯৫৫ সালে এবং ওটি মাগডেবুর্গের বিশপের ক্যাথিড্রাল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ৯৬৮ সালে। ৯৭৩-তে যখন সম্রাট ওত্তো মারা যান তখন ওঁকে এক পাথরের সক্রোফ্যাগাস (কফিন)-এ ওই ক্যাথেড্রালেই সমাধিস্থ করা হয়।

১২০৭ সালে এই ক্যাথিড্রাল এক আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন আর্চবিশপ আলব্রেশ্ট দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত নেন এক নতুন “আধুনিক” ক্যাথিড্রাল বানানোর। কাজ শুরু হয় দু বছর পর আর চলে ১৩৬২ পর্যন্ত যখন ওই “আধুনিক” গথিক ক্যাথিড্রাল দেবসেবায় উৎসর্গ করা হয়। ক্যাথিড্রালের দক্ষিণের পরিচিত দুই মিনার, যার উচ্চতা ১০৪ মিটার, অবশ্য শেষ হয় ১৫২০ সালে, যখন জার্মান স্থাপত্যে গথিক প্রভাব ছিল চোখে পড়ার মতো।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্যাথিড্রালটি যদিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, কিন্তু মিনারগুলো বেঁচে যায়। যুদ্ধের পর বাকি জায়গা মেরামত করে আবার ওটির দরজা খুলে দেয়া হয় সর্বসাধারণের জন্য। 

মাগডেবুর্গ ক্যাথিড্রালের কোনো প্রবেশমূল্য নেই কিন্তু আপনি যদি একটা গাইডেড ট্যুর বুক করেন তবে ৪৩৩ টি সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে পারেন ঘন্টাঘরে, যেখান থেকে শহর এবং এল্বে নদী দেখা যায় খুব সুন্দর।

অক্টোবর ৩, ২০০৫-এ উদ্বোধিত দা গ্রীন সিটাডেল অফ মাগডেবুর্গ শহরের দ্রষ্টব্যের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে পড়ে।

অস্ট্রিয়ার আর্কিটেক্ট ফ্রিয়ডেন্সরেইচ হুন্ডারটিয়াসের এই ইমারতের উপর কাজ করেন ২০০০ সালে তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগেই পর্যন্ত। এই ভবনটির উদ্দেশ্য “যুক্তিসঙ্গত বাড়িঘরের সমুদ্রের মাঝে মনুষ্যজাতির জন্য এক মরূদ্যান” হয়ে থাকা মাগডেবুর্গ নামক “কংক্রিট মরুভূমির” মাঝখানে।

দা গ্রীন সিটাডেল অফ মাগডেবুর্গ
দা গ্রীন সিটাডেল অফ মাগডেবুর্গ

বাড়িটি বানানোর পিছনের চিন্তাভাবনা শুরু থেকেই বিতর্কিত এবং সেই বিতর্ক আজ ও চলে। 

বাণিজ্যিক এবং আবাসিক ব্যবহারের জন্য বানানো এই বাড়ি সহজেই চেনে যায় এর অবস্বাভাবিক ধাঁচ এবং রঙের জন্য। Breiter Weg-এর উপর অবস্থিত এই বাড়ির রং যদিও গোলাপি, এটি গাছ-গাছালিতে ভরপুর। এর মধ্যে আছে ৫৫টি এপার্টমেন্ট, সর্বসাধারণের জন্য কয়েকটা চত্বর, অনেক দোকান, রেস্তোরাঁ, ক্যাফে আর একটা ছোট ৪২-ঘরের হোটেল। মাগডেবুর্গ ক্যাথিড্রালের ঘন্টাঘর থেকে এই সিটাডেল সুন্দর দেখা যায়। 

আমি নিজে মাগডেবুর্গ গিয়েছিলাম কালচারহিস্টোরিসিশ মিউজিয়াম (সাংস্কৃতিক ইতিহাসের জাদুঘর) এর জন্য। এটিও শহরের এক প্রধান দ্রষ্টব্য। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া দ্বিতীয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবি হলো ভিন্সেন্ট ভ্যান গঘের ‘দা পেইন্টার অন দা রোড টু টারাস্কোন’ (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হারিয়ে যাওয়া ছবি হলো রাফায়েলের সেল্ফ পোর্ট্রেট)। সেই ভ্যান গঘের ছবিটির মালিক হলো এই জাদুঘর। আমার বই এই ছবির হারিয়ে যাওয়াকে কেন্দ্র করে এবং সেই কারণে আমি মিউজিয়ামের কিউরেটরের সাথে কথা বলতে চেয়েছিলাম।

এখানে অন্যান্য অনেক ছবি-ভাস্কর্য আছে যা যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। পনেরো থেকে কুড়ির দশকের ছবি, সেরামিসের জিনিস, আসবাব এসব আছে।

এছাড়া, নিজের বইয়ের জন্য আমি ওত্তো ভ্যান গুয়েরিকে ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিতেও বেশ কিছু সময় কাটাই। সবার জন্যই খোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাজানো গোছানো ক্যাম্পাস আর বিশাল লাইব্রেরি। 

প্রথম ওত্তো -র মূর্তি

ট্রেন স্টেশন থেকে মিনিট পাঁচেক হাঁটাপথ ফ্রাউননব্রুনেন। স্থানীয় ভাস্কর হাইনরিচ আপেলের ১৯৮৬-এ বানানো এই ফোয়ারা একটা দেখার মতো জিনিস। এক বিশাল ব্রোঞ্জের কড়াই আর তার মধ্যে এন্ড আশেপাশে বাইশখানা বাস্তব এবং কাল্পনিক জন্তুজানোয়ার আর মানুষের মূর্তি। এই ফোয়ারার চারদিকে ঘুরে দেখুন তো, সবকটা কিসের কিসের মূর্তি আছে চিনতে পারেন কিনা?

এল্বে নদীর পাশে অবস্তিত এই শহরে প্রধান পাবলিক ট্রান্সপোর্ট বাস আর ট্রাম (জার্মানে ‘ডি স্ট্রাসেনবান’)। যে দ্রষ্টব্যগুলোর কথা লিখলাম ওগুলো ছাড়াও বেশ কয়েকটা মিউজিয়াম, বিভিন্ন কুইসিনের রেস্তোরাঁ, সাইক্লিং রুট আর চার্চ আছে এখানে।

শহরের নাইটলাইফ বার্লিনের সাথে তুলনা করা চলবে না, কিন্তু একদম নেই তা নয়। সন্ধেবেলা সঙ্গীদের সাথে বা পিপল-ওয়াচ করার জন্য চলে যান ক্যাফে সেন্ট্রাল। লাইবিগ লাউঞ্জ র স্টার্ন আরো ‘হ্যাপেনিং’ জায়গা। কিন্তু একটা কথা বলে রাখা ভালো, পাবগুলো ছাড়া বাকি শহর কিন্তু ঘুমিয়ে পরে একটু তাড়াতাড়ি। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে মাগডেবুর্গ গুরুত্বপূর্ণ শহর। ১৫ই জানুয়ারী ১৯৪৫-এর রাতে ব্রিটিশ রয়েল এয়ার ফোর্স এখানে “কার্পেট বম্বিং” চালায়। ৩৭১ টি যুদ্ধবিমানের ৩৯ মিনিট আক্রমণে ২,৫০০ মানুষ প্রাণ হারান, ১১,০০০ আহত হন এবং ১৯০,০০০ গৃহহীন হয়ে পড়েন। শহরটি একটি ধ্বংসস্তূপ থেকে পুনর্নির্মিত কেমন হয়েছে, সেটাও একটা দেখার জিনিস।  

অতএব টুরিস্ট ট্রেইল এর বাইরে গিয়ে আপনার জার্মানি ট্রিপ এর ইটিনেরারিতে মাগডেবুর্গকে দুদিন জায়গা দিতেই পারেন।

———-

An edited version of this article appeared on the June 30 edition of Sananda Travel.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More Travel News